
📰 স্টাফ রিপোর্টার | দৈনিক শেষ কথা | বরগুনা |
৯ নভেম্বর ২০২৫
সবুজে ঘেরা আমতলী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ঘোপখালী। গ্রামের প্রবেশমুখে চোখে পড়ে এক বিশাল, জরাজীর্ণ ভবন—গাছপালা আর নীরবতার আবরণে ঘেরা সেই পুরোনো স্থাপনাটি যেন হারিয়ে যাওয়া এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কখনো তিনতলা বিশাল অট্টালিকা ছিল এটি। এখন কেবল দুইতলা অবশিষ্ট। ধসে পড়া কাঠামোর মাঝেও লাল-ধূসর ইটের দেয়াল, খিলানযুক্ত বারান্দা ও কারুকার্যময় জানালা যেন নীরবে বলছে এক সমৃদ্ধ অতীতের গল্প।
🔸 ব্রিটিশ স্থাপত্যের প্রভাব
বাড়িটির স্থাপত্যে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ব্রিটিশ আমলের প্রভাব। নিচতলার সাতটি খিলান, মাঝের গম্বুজধর্মী কাঠামো, জানালায় ব্যবহৃত কলাম—সব মিলিয়ে ভবনটি রোমান-গথিক ধাঁচের। ইট-চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি ভবনটির দেয়াল প্রায় ২৪ ফুট পুরু। প্রতিটি খিলানের ওপর রুফ-কার্নিশে রয়েছে সূক্ষ্ম অলংকরণ।
ভেতরে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। কাঠের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে ধুলো ও মাটি। একসময় যে রঙিন কাচ জানালায় ঝলমল করত, আজ তা ভাঙা টুকরোয় মিশে আছে অতীতের স্মৃতিতে।
🔸 ইতিহাসের শিকড়
বর্তমান বাসিন্দা ও ষষ্ঠ প্রজন্মের উত্তরসূরি বাছের উদ্দিন, যিনি একজন কলেজশিক্ষক, জানান—এই বাড়ির নির্মাতা ছিলেন ফটিক হাওলাদার। তাঁর বাবা ঝরু হাওলাদার আঠারো শতকে পটুয়াখালীর বাউফল থেকে এই এলাকায় এসে বসতি গড়েন। বনজঙ্গলে ভরা সেই এলাকা সাফ করে তিনি কৃষিজমি ‘হাওলা’ করেন এবং মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পান ফটিক হাওলাদার।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ফটিক হাওলাদার গড়ে তোলেন বিশাল এই ভবন। পরবর্তীতে তিনি ‘তালুকদার’ উপাধি পান এবং পরিবারটি পরিচিত হয় ‘ফটিক হাওলাদার তালুকদার পরিবার’ নামে।
একসময় তাঁদের এক হাজার একর ফসলি জমি ছিল, যার বড় অংশ ফটিক হাওলাদার ওয়াক্ফ করেন। বর্তমানে তাঁদের এস্টেটে প্রায় ৯১ একর সম্পত্তি অবশিষ্ট আছে। সেই এস্টেটের মোতোওয়ালি এখন বাছের উদ্দিন নিজেই।
🔸 সময়ের সাক্ষী স্থাপনা
বাড়িটির উত্তর পাশে রয়েছে একটি প্রাচীন মসজিদ এবং বিশাল পুকুর, যার শানবাঁধানো ঘাট আজও ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ পাশে ছিল কাছারিঘর। মসজিদের পাশেই ফটিক হাওলাদার ও তাঁর পিতা ঝরু হাওলাদারের কবর। বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চিতে লেগে আছে অতীতের ঐশ্বর্যের ছোঁয়া।
ফটিক হাওলাদারের নাতি মুশফিকুর রহমান (৭৩) বলেন,
“আমার দাদা কলকাতা থেকে মিস্ত্রি এনে এই ভবন নির্মাণ করেছিলেন। আসবাবসহ অনেক কিছুই কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল। আজ সব ধ্বংসপ্রায়। সরকার যদি এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণ করে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদের ঐতিহ্যের কথা।”
🔸 সংরক্ষণের উদ্যোগ
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন,
“আমতলীর ঘোপখালী গ্রামে শতবর্ষের এই ভবনের বিষয়ে আমি প্রথমবার জানলাম। স্থানীয় ইউএনওকে বিষয়টি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলব। যদি এটি ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন হয়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে অবহিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
🔸 উপসংহার
বরগুনার ঘোপখালীর এই পুরোনো স্থাপনাটি শুধু একটি বাড়ি নয়—এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সময়ের নীরব দলিল। সঠিক উদ্যোগ নিলে এটি হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের এক অনন্য ঐতিহ্যবাহী পর্যটনস্থল, যা পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবে বরগুনার গৌরবময় অতীতের গল্প।
দৈনিক শেষ কথা
“সত্য ও সচেতনতার পথে”
📍 বরগুনা সদর | ✍️ প্রতিবেদন প্রস্তুত: স্টাফ রিপোর্ট টিম