
দৈনিক শেষ কথা প্রতিনিধি
জুলাই গণঅভ্যুত্থনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার দুপুরে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
দুপুর পৌনে ১টার দিকে ছয় অধ্যায়ে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু হয়। রায়ে পাঁচটি অভিযোগে শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানায় ট্রাইব্যুনাল।
রায়ে কী বলা হয়েছে-
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, “আমরা ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই মত দিচ্ছি যে, তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় নির্বিচারে ও নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করে যে ঘৃণিত অপরাধ করেছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে না।”
ট্রাইব্যুনালের মতে, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ, উস্কানি, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সশস্ত্র দলীয় সদস্যরা সংগঠিতভাবে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায়।
অভিযোগসমূহ-
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১. উস্কানিমূলক বক্তব্য ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে আক্রমণ
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র দলীয় সদস্যরা সংগঠিতভাবে ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায়। এতে হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
২. হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ
আন্দোলনকারীদের নির্মূলের উদ্দেশ্যে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা—এ অভিযোগও প্রমাণিত। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি এ নির্দেশ বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন।
৩. আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র ছাত্র আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি করে হত্যা করা হয়—এ ঘটনায় তিন আসামির প্ররোচনা, নির্দেশ ও সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে।
৪. চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জন নিহত হন—এর দায়ও আসামিদের ওপর বর্তায় বলে রায়ে উল্লেখ।
৫. আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও পুড়িয়ে ফেলা
আন্দোলনরত ছয় শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা এবং পাঁচজনের মৃতদেহসহ একজন জীবিতকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় আসামিদের নির্দেশ, ষড়যন্ত্র, উস্কানি ও সহায়তা প্রমাণিত হয়েছে,
কোন অপরাধে কী সাজা :
শেখ হাসিনা-
একটি অভিযোগে (প্রথম অভিযোগ) সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি প্রমাণিত হওয়ায় আমৃত্যু কারাদণ্ড।
দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড।
আসাদুজ্জামান খান কামাল-
চানখাঁরপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যা
আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা ও পুড়িয়ে ফেলা
→ দুই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন (একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি ও রাজসাক্ষী)
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তদন্তে সহায়তা করায় তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়—
“তিনি সব অ্যাট্রোসিটির জন্য দায়ী হলেও ঘটনার পূর্ণ বিবরণ আদালতকে দিয়েছেন; তাই ন্যূনতম শাস্তি প্রাপ্য।”
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ-
রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করে, জুলাই গণঅভ্যুত্থনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত, পদ্ধতিগত ও সংগঠিত অপরাধ।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছেন—এটি তার দায়কে আরও বাড়িয়ে দেয়।
শেষ কথা –
রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থনে নিহত শত শত ছাত্র-জনতার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিতের দাবি আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই রায় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।